স্বদেশ ডেস্ক:
ইউক্রেনের বর্তমান সংকটের শিকড় অনেক গভীরে এবং যা অবশ্যই ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বেশিরভাগ পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মধ্য ইউরোপে তার কৌশলগত অবস্থানের জন্য ইউক্রেনকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনর্গঠন প্রচেষ্টার প্রধান কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এবং বাল্টিক রাজ্যের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার, শক্তি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার কৌশল ও পরিকল্পনার অংশ হলো ইউক্রেনের ওপর প্রভাব বিস্তার।
পুতিন ইউরোপের দিক থেকে রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য একটি প্রধান ভূমিকা চাইছেন। কারণ গত দুই দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বেশিরভাগ ন্যাটো মিত্ররা ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাবকে অধস্তন করার চেষ্টা করেছে। রাশিয়ার মহাশক্তির মর্যাদা পুনরুজ্জীবিত করা, অ-হুমকিপূর্ণ উপায়ে রাশিয়ার উচ্চাকাক্সক্ষাগুলোকে বাস্তবায়ন এবং নতুন শীতল যুদ্ধ এড়ানোর জন্য পশ্চিমা প্রচেষ্টাকে নষ্ট করার জন্য রাশিয়ার ইউক্রেন প্রভাব বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুতিন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিপ্রায় প্রকাশ করছেন একটি বিস্তৃত রাশিয়ান-আধিপত্যযুক্ত সুরক্ষা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, যা সোভিয়েত যুগে মস্কোর শক্তির মতো হবে। এখন ৬৯ বছর বয়সে এবং সম্ভবত তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে তিনি স্পষ্টতই রাশিয়ার কক্ষপথে ৪৪ মিলিয়ন মানুষের দেশ ইউক্রেনকে সংযুক্ত করতে চান। পুতিন ইউক্রেনকে রাশিয়ার ‘প্রভাবের ক্ষেত্র’- একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি অঞ্চল হিসেবে দেখে।
রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মধ্যে আস্থা ভেঙে যাওয়ার কারণগুলোও ইউক্রেন সংকটের আরেকটি কারণ। রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে, আস্থার ক্ষয় শুরু হয়েছিল মার্কিন এবং পশ্চিমা নেতৃত্বের দ্বারা ১৯৯০ সালে জার্মানির একীকরণের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি যে, পূর্বে ন্যাটোর কোনো সম্প্রসারণ হবে না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, ন্যাটো পূর্ব দিকে প্রসারিত হয়, অবশেষে কমিউনিস্ট বলয়ের মধ্যে থাকা বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ ন্যাটোতে যোগ দেয়। লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়ার বাল্টিক প্রজাতন্ত্র, এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং অন্যদের মতো ন্যাটোতে যোগদান করেছিল। পরিকল্পনা ছিল ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার। রুশ প্রেসিডেন্ট ন্যাটোর সম্প্রসারণকে হুমকি হিসেবে এবং ইউক্রেনের এতে যোগদানের সম্ভাবনাকে তার দেশের জন্য একটি অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে ইউক্রেনের সরকার পশ্চিমাদের কাছাকাছি আসছে এবং প্রকাশ্যে বলেছে যে, ২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করবে এবং ন্যাটোর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও তার রয়েছে।
আধুনিক ইউক্রেন সংকট শুরু হয়েছিল নিকিতা ক্রুশ্চেভের ১৯৫৪ সালে ইউক্রেনীয়-রাশিয়ান একীকরণের ৩০০তম বার্ষিকী উদযাপনের জন্য রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল রিপাবলিক থেকে ইউক্রেনীয় সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল রিপাবলিক থেকে ক্রিমিয়া হস্তান্তরের মাধ্যমে। যেহেতু উভয় প্রজাতন্ত্রই সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ছিল, তাই এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, ১৯৯১ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত, যখন সদ্য স্বাধীন ইউক্রেনে ক্রিমিয়ার অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। তা ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বৃহত্তর অর্থনৈতিক একীকরণের জন্য একটি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নভেম্বর ২০১৩ সালে রাজধানী কিয়েভ শহরে বিক্ষোভের মাধ্যমে ইউক্রেনের মূল সংকট শুরু হয়েছিল। বিক্ষোভের মধ্যে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
মার্চ ২০১৪ সালে, রাশিয়ান সৈন্যরা ইউক্রেনের ক্রিমিয়ান অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। একটি বিতর্কিত গণভোটে ক্রিমিয়ানরা রাশিয়ান ফেডারেশনে যোগদানের জন্য ভোট দেয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ক্রিমিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ান নাগরিক ও রাশিয়ান ভাষাভাষীদের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। এই সংকটটি জাতিগত বিভাজন বাড়িয়ে তোলে এবং দুই মাস পর পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউক্রেন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য একটি গণভোট আয়োজন করে।
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে সংকট বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্ববাজারে ঝড় তুলেছে। সংকটটি জি-৭ দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের একটি যৌথ বিবৃতি জারি করতে প্ররোচিত করে, “যদি রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে তবে তার জন্য ‘ব্যাপক’ অর্থনৈতিক ও আর্থিক অবরোধ করা হবে।” কিন্তু এর ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় ইউরোপ বেশি পরিমাণে প্রভাবিত হবে। রাশিয়া বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক গ্যাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক, যা ২০২০ সালে সরবরাহের প্রায় ১৭ শতাংশ। রাশিয়া তার উৎপাদনের ৩৫ শতাংশেরও বেশি রপ্তানি করে এবং প্রায় ৭০ শতাংশ পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে পাঠায়, যার বেশিরভাগই ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে যায়। সবচেয়ে বড় হলো নর্ড স্ট্রিম ১, যার ক্ষমতা বার্ষিক ৫৫ বিলিয়ন ঘনমিটার।
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন রাশিয়া থেকে জার্মানিতে প্রাকৃতিক গ্যাস স্থানান্তর করার জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইনকে বন্ধ করার কথা বলেছেন। কিন্তু জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোল্টজ তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হননি, কারণ জার্মানির প্রাকৃতিক গ্যাসের অর্ধেকেরও বেশি রাশিয়া সরবরাহ করে। তা ছাড়া রাশিয়া জার্মানির কয়লা আমদানির অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করে। রাশিয়ান পাইপলাইন রপ্তানিতে বাধা, তেলের দামের ওপর প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের জন্য ব্যারেলপ্রতি ৯৫ ডলার, যা এই বছরের শুরুতে প্রায় ৭০ ডলার থেকে বেড়েছে। গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে ইউরোপীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে। যা তেলের দামকেও প্রভাবিত করবে, তেলের দাম $১২০ বিবিএল হতে পারে। রাশিয়ান তেল রপ্তানি অর্ধেক হলে ব্রেন্ট তেলের দাম ১৫০ বিবিএল ডলার হবে।
রাশিয়া বিরল খনিজ এবং ভারী ধাতুগুলোর একটি প্রধান রপ্তানিকারক- যেমন বিমানে ব্যবহৃত টাইটানিয়াম। রাশিয়া বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্যালাডিয়াম সরবরাহ করে। ইউক্রেনের সংঘর্ষ ইউক্রেনীয় শিল্পগুলোকেও ব্যাহত করবে। ইউক্রেন নিয়নের একটি প্রধান উৎস, যা সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফলে মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর এবং মহাকাশ শিল্পসহ বিভিন্ন সেক্টরে সাপ্লাই চেইন বিঘিœত হবে। ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয় দেশেই প্রচুর পরিমাণে সার উৎপাদিত হয়। এই রপ্তানিতে বাধাগুলো বেশিরভাগই ইউরোপের কৃষিকে প্রভাবিত করবে, তবে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার ধাক্কা বিশ্ববাজারে আঘাত করতে পারে। নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।